আদিবাসী কাকে বলে ও আদিবাসীদের বৈশিষ্ট্য কী কী

Written by Mas-IT Team

Updated on:

আদিবাসী জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে এবং তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জীবনযাত্রা স্থানীয় জনজীবনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের মতো একটি বহুজাতিক দেশে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অবদান এবং তাদের পরিচিতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ সর্বজনীন। এই আর্টিকেলএ আমরা আদিবাসী কাকে বলে,আদিবাসীদের পরিচিতি, বৈশিষ্ট্য, এবং তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

আদিবাসী কাকে বলে

আদিবাসী সংজ্ঞা

“আদিবাসী” শব্দটি এসেছে “আদি” এবং “বাসী” শব্দের সমন্বয়ে, যার অর্থ প্রথম বা প্রাচীন বাসিন্দা। আদিবাসী হলো সেই জনগোষ্ঠী যারা প্রাচীনকাল থেকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাস করছে এবং যাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি স্থানীয় সমাজের থেকে ভিন্ন।

আদিবাসী কারা

আদিবাসীদের চিহ্নিত করা হয় তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ভাষা, এবং ঐতিহ্যের মাধ্যমে। তাদের সমাজব্যবস্থা সাধারণত প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের সাঁওতাল, চাকমা, গারো, মারমা প্রভৃতি জনগোষ্ঠী আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত।

বাংলাদেশের আদিবাসী তালিকা

নিচে বাংলাদেশের ৫৩টিরও বেশি আদিবাসী গোষ্ঠীর নাম ছক আকারে দেওয়া হলো:

ক্রমআদিবাসী গোষ্ঠীক্রমআদিবাসী গোষ্ঠী
1চাকমা28বানাই
2মারমা29হাজরা
3ত্রিপুরা30ধালি
4সাঁওতাল31রাজবংশী
5মণিপুরী32কাশ্যপ
6গারো33শবর
7খাসিয়া34বরাই
8হাজং35গোরা
9মুরং36মালো
10রাখাইন37কাদারিয়া
11বম38বাঁশফোর
12লুসাই39মেথর
13তঞ্চঙ্গ্যা40দলুই
14পাংখোয়া41বাগদি
15খুমি42কুচ
16চাক43মালপাহাড়ি
17কুকি44সিধো
18রিয়াং45ঝুমিয়া
19উরাও46বারুই
20ভূমিজ47টোটো
21কোল48ভুজপুরিয়া
22মাহালী49নাহাল
23পাত্রা50রাজোয়ার
24সিং51সোরিয়া
25গোত্র52মেচ
26বেদে53ভাগল
27লোহারা

আদিবাসী ও উপজাতির মধ্যে পার্থক্য

অনেক সময় “আদিবাসী” এবং “উপজাতি” শব্দ দুটি গুলিয়ে ফেলা হয়। তবে এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে।

আদিবাসীউপজাতি
প্রাচীন বাসিন্দা হিসেবে পরিচিত।বড় জাতিগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে বিবেচিত।
স্বতন্ত্র ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে।বড় জাতির সংস্কৃতির প্রভাব বিদ্যমান।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবহৃত।

আদিবাসীদের বৈশিষ্ট্য কী কী

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাত্রা এবং তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলে। আদিবাসী সমাজের প্রতিটি দিক তাদের স্বকীয়তা এবং ঐতিহ্যের গভীর রূপকে প্রকাশ করে। তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো:

১. স্বতন্ত্র সংস্কৃতি

আদিবাসী গোষ্ঠীর নিজস্ব নাচ, গান, পোশাক এবং উৎসব তাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, চাকমা ও মারমাদের “বিজু উৎসব” তাদের ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতিটি গোষ্ঠীর শিল্প, হস্তশিল্প এবং লোককথা তাদের সাংস্কৃতিক ধারা গঠনে সহায়ক।

২. ভাষার বৈচিত্র্য

আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে, যা তাদের জাতিগত পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যেমন, সাঁওতালদের সাঁওতালি ভাষা এবং মণিপুরীদের মণিপুরি ভাষা তাদের ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। এ ভাষাগুলো শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং তাদের ইতিহাস এবং জীবনধারার প্রতিফলন।

৩. প্রকৃতি-নির্ভর জীবনধারা

প্রকৃতি-নির্ভর জীবনযাত্রা আদিবাসীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাদের জীবিকা কৃষি, শিকার, এবং বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ জীবনধারা তাদের প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করেছে।

৪. সামাজিক একতা

আদিবাসী সমাজব্যবস্থা সাধারণত সমবায় ভিত্তিক। এখানে সবাই একে অপরকে সহযোগিতা করে। যেমন, একটি গারো পরিবারে বিয়ে বা উৎসবের সময় পুরো সম্প্রদায় একত্রে কাজ করে। এই সামাজিক বন্ধন তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি করে।

৫. ধর্মীয় বিশ্বাস

তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস প্রকৃতি-নির্ভর। অধিকাংশ আদিবাসী সূর্য, চাঁদ, বন, পাহাড় প্রভৃতির পূজা করে। উদাহরণস্বরূপ, সাঁওতালরা “মারাং বুরু” দেবতার পূজা করে। তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান তাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

৬. জীবনযাত্রার সরলতা

আদিবাসীদের জীবনযাত্রা সাধারণত সহজ এবং নির্ভেজাল। তারা স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার করে জীবনধারণ করে। এই সরলতা তাদের মানবিক দিক এবং প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার পরিচয় বহন করে।

৭. শিল্পকলার দক্ষতা

আদিবাসীরা হস্তশিল্প, বুনন, এবং মাটির কাজের জন্য পরিচিত। এই শিল্প তাদের জীবিকা অর্জনের একটি প্রধান উৎস এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক।

আদিবাসীদের বৈশিষ্ট্য তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক জীবনের একটি সম্মিলিত প্রতিচ্ছবি। তাদের জীবনধারা আমাদের সমাজের জন্য একটি অনুপ্রেরণা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতীক। আদিবাসীদের এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের প্রকৃতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতার প্রমাণ বহন করে।

বাংলাদেশের আদিবাসীদের পরিসংখ্যান

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.৮% আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত। তারা প্রধানত পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং উত্তরাঞ্চলে বসবাস করে। কিছু গোষ্ঠী সমতলভূমিতেও ছড়িয়ে আছে।

অঞ্চলগোষ্ঠীজনসংখ্যা
পার্বত্য চট্টগ্রামচাকমা, মারমা, ত্রিপুরা১০ লক্ষ+
উত্তরাঞ্চলসাঁওতাল, মণিপুরী৫ লক্ষ+

বাংলাদেশে বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর জনসংখ্যার পরিসংখ্যান দেওয়া হলো। এ তথ্য সাধারণত আদমশুমারি এবং গবেষণার মাধ্যমে সংগৃহীত হয়। তবে জনসংখ্যা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর আনুমানিক জনসংখ্যা ছক আকারে দেওয়া হলো:

ক্রমআদিবাসী গোষ্ঠীজনসংখ্যা (প্রায়)অঞ্চল
1চাকমা৫,০০,০০০+পার্বত্য চট্টগ্রাম
2মারমা২,০০,০০০+পার্বত্য চট্টগ্রাম
3ত্রিপুরা১,৫০,০০০+পার্বত্য চট্টগ্রাম
4সাঁওতাল৩,৫০,০০০+রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর
5মণিপুরী৫০,০০০+সিলেট
6গারো১,২০,০০০+ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা
7খাসিয়া৩০,০০০+সিলেট
8হাজং২৫,০০০+ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা
9মুরং৫০,০০০+বান্দরবান
10রাখাইন২০,০০০+কক্সবাজার, পটুয়াখালী
11বম১৫,০০০+বান্দরবান
12তঞ্চঙ্গ্যা৫০,০০০+পার্বত্য চট্টগ্রাম
13পাংখোয়া১০,০০০+পার্বত্য চট্টগ্রাম
14খুমি৫,০০০+বান্দরবান
15চাক৩,০০০+বান্দরবান
16কুকি৫,০০০+বান্দরবান
17লুসাই৩,৫০০+পার্বত্য চট্টগ্রাম
18উরাও১,০০,০০০+রাজশাহী, দিনাজপুর
19ভূমিজ৩০,০০০+রাজশাহী, খুলনা
20মাহালী২০,০০০+রাজশাহী, খুলনা

সংক্ষেপে

  • সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা: চাকমা ও সাঁওতাল।
  • অধিকাংশ পার্বত্য অঞ্চলে: চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা।
  • সমতলভূমিতে: সাঁওতাল, গারো, উরাও।

FAQ (প্রশ্নোত্তর)

প্রশ্ন ১: আদিবাসী কাকে বলে?

উত্তর: আদিবাসী হলো সেই জনগোষ্ঠী যারা প্রাচীনকাল থেকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাস করে এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা ও জীবনযাত্রা রয়েছে।

প্রশ্ন ২: আদিবাসীদের বৈশিষ্ট্য কী?

উত্তর: আদিবাসীদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি, প্রকৃতিনির্ভর জীবনযাত্রা, এবং সামাজিক একতা।

প্রশ্ন ৩: আদিবাসী ও উপজাতি কি একই?

উত্তর: না, আদিবাসী ও উপজাতি এক নয়। আদিবাসী প্রাচীন বাসিন্দা হিসেবে পরিচিত, আর উপজাতি হলো বড় জাতিগোষ্ঠীর অংশ।

লেখকের শেষ কথা

আদিবাসী কাকে বলে
আদিবাসী কাকে বলে

তবে, আদিবাসীরা নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি। তাদের জমি অধিকার, শিক্ষা, এবং স্বাস্থ্যসেবায় অবহেলা তাদের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকার এবং সমাজের উচিত তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় আরও উদ্যোগী হওয়া।

লেখক হিসেবে, আমি মনে করি আদিবাসীদের সঠিক পরিচিতি তুলে ধরা এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাদের সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে আমরা বাংলাদেশের প্রকৃত বহুমাত্রিক পরিচয়কে রক্ষা করতে পারি। আসুন, সবাই মিলে তাদের অধিকার এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসি।

রিলেটেড:আদিবাসী গোষ্ঠী, আদিবাসী সমাজব্যবস্থা, আদিবাসীদের ইতিহাস, বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়, আদিবাসী জনগণের সংস্কৃতি, আদিবাসীদের ভূমি অধিকার, আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি, বাংলাদেশে আদিবাসী জনগণের অধিকার, আদিবাসী জীবনধারা, আদিবাসী ঐতিহ্য, আদিবাসী সমাজের সমস্যা, আদিবাসী জনগণের পরিচিতি, আদিবাসী ঐতিহাসিক অবদান, বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণের জনসংখ্যা, আদিবাসী বনাম স্থানীয় জনগণ

Mas-IT Team

হ্যালো, আমি জারীফ। আমি একজন স্টুডেন্ট। আমি মূলত শিক্ষা বিষয়ে লেখালেখি করে থাকি। আশাকরি আমি আপনাদের সঠিক তথ্য দিতে পারছি।

Leave a Comment